শীত-স্মৃতিতে শৈশবের গল্প লিখেছেন আল শাহারিয়া। শৈশব জীবনের অন্যতম মধুর একটা সময়। এমন লোক হয়তো নেই, যে শৈশবে ফিরে যেতে চায় না। আর শীতের শৈশব আরো একটু অন্যরকম।
নবান্নের দেশ জুড়ে নরম কাদা মাখা শরীর সূর্যের তাপে সংকুচিত হয়ে আসে৷ কী অদ্ভুত গন্ধ সে মাটির‚ কী অদ্ভুত ভালো লাগা উড়ে বেড়ায় বাতাসে! শীতকালীন দুপুরের রোদ মানেই স্বর্গ। বিকেল মানেই চাদরের নিচ দিয়ে চুইয়ে যাওয়া মৃদু বাতাস।
বয়স তখন দশ-বারো। পৌষের দুপুর। পুকুরের পানি সেচে চলছে মাছধরা। আমার মতো কচিকাঁচার ভীড় বেড়েই চলেছে। আমিও তাদের দলে। ফেলে যাওয়া মাছ-কুড়ানির দলে। টেংরা‚ পুঁটি‚ তেলাপিয়া— যে যা পায় তাই ধরে। পাঁকাল মাছের সন্ধানে ছোটে। লুকিয়ে রাখে। সাবধানে পা ফেলে শিকারীর বেশে। বিপদের আশঙ্কায় কেউ আবার বেশি নড়েচড়ে না। আমিও তেমন। পায়ে টেংরামাছ কাঁটা ঢুকিয়েছিলো বেশ ক’দিন আগে। আব্বুর সাথে ওটাই ছিলো আমার শেষ মাছ ধরতে যাওয়া। টেংরামাছকে ছিলো ভীষণ ভয়। মাছধরা শেষ। গায়ে কাদা-মাটি লেগে একাকার। সূর্য তখন মাঝ আকাশে। পাশেই ধানক্ষেত। পাকা ধানের মৃদু গন্ধ টের পাচ্ছি। মনে হলো চোখটা বন্ধ করে সবটুকু ভালো লাগা টেনে নিই বুকের মধ্যে। কিন্তু‚ দূরন্ত শৈশবে এই সুযোগ নেই।
স্নানাহার শেষ করে অনিচ্ছাকৃত একটু ঘুম। শাস্তির ভয়ে শুয়ে থাকা বলা যায়। দুপুর গড়িয়ে যেই না বিকেল সমস্ত বাধা-বিপত্তি‚ ঘুম‚ নিষেধ উড়ে যায়। সকালের মতো বিকেলেও ব্যাগ হাতে ধান কুড়ানো। মনে পড়ে একবার নিজেদের ক্ষেতে ধান কুড়াতে গিয়ে কাঁচিতে হাত কেটে গিয়েছিলো। সেবার আব্বুর বকুনির সামনে আর ধান কুড়ানো হয়নি। ধান কুড়ানোর তখন একটাই কারণ ছিলো। সেটা হলো রাতে খেজুর রসে ডুবানো গরম জিলিপি খাওয়া। দাদিমা সেবার লুকিয়ে জিলিপি খাওয়ার ধান দিয়েছিলো আমাকে।
শীতের রাতে ঘুমাতে যেতাম দ্রুত। গ্রামের বাড়িগুলোতে শহরের মতো শক্তিশালী আলো নেই‚ ভারী কোনো দুশ্চিন্তা নেই‚ কোনো ব্যস্ততা নেই বলেই বোধহয় সবাই দ্রুত ঘুমায়। আমার ঘরের জানালায় তখন জোৎস্না আর নোনাপানি ছুঁয়ে আসা খুনে বাতাস। চোখ অসাড় করে দেওয়া বাতাস। চোখ মেলে তাকানো অসম্ভব ব্যাপার। সোয়েটার ছুঁড়ে ফেলে সন্ধ্যাতেই গায়ে চড়ে কাঁথা। শীতকাঁথার গল্প আছে অনেক। আম্মুর তৈরি কাঁথা আমি দশমাসই গায়ে চড়াই। মাঝেমাঝে রাতে উঠানে দাদিমার সাথে খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিতাম।
শুকানোর জন্য বিছিয়ে দেওয়া কুঁটোর উপর বসে দুপুরের যত খাবার খেয়েছি তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। হাত আর সমস্ত ভাত লাল করা চিংড়িমাছ দিয়ে লালশাক ছিলো অমৃত। দুপুরের রোদে বসে খাওয়ার যে প্রবল ইচ্ছে মাঝেমাঝে জাগতো সেগুলো আবার আম্মুর তিরস্কারের সামনে নতজানু হয়ে পড়েছে অধিকাংশ সময়। তবু‚ যে কয়টা দিন পেয়েছি তা ছিল অনিন্দ্য।
শীতের সকাল নিয়ে অনেকেই লিখেছেন অনেককিছু। আমার শীতের সকাল মানেই ছিল ঘুম‚ নানাবাড়িতে থাকলে রস পাড়তে যাওয়া‚ সেই রস থেকে বড়ো পাত্রে করে গুড় বানাতে দেখা। রস থেকে গুড় বানানো হয়ে গেলে আমরা কচিকাঁচারা আঙুল দিয়ে পাত্র থেকে গরম গুড় তুলে খেতাম। অবশিষ্ট হলেও স্বাদ যেন মূল গুড়ের চেয়েও সুন্দর। যে গুড় বানানো হতো তা দিয়ে অনেক জিনিস বানাতো নানুরা। বরই এর আচার আমার সবচেয়ে প্রিয়। এখনও শীতকাল এলে নানা বাহানায় আমি নানাবাড়িতে গিয়ে আচার খেয়ে আসি।
শীত মৌসুমে পিঠা খেয়েছি চুলার পাশে বসেই। পিঠা খাওয়াটা জরুরি‚ নাম জানাটা নয়। ভাপা পিঠা আর রসে ভেজা চিতই পিঠার শরীরের কাছাকাছি নাক আনলে এখনও আমি শৈশবে ফিরি। এখন আর মিষ্টি খেতে পারি না‚ যা খাই কাঁচি-চামচে; গন্ধ পাই না। এভাবেই বুঝি সবকিছু ফুরিয়ে যায় বড়ো হতে হতে।
শৈশব মনে করে তোমাদের থেকে একা হই‚
শৈশব হারিয়ে আমি শূন্যতাটুকু নিয়ে বেঁচে রই।
আর সবার মতোই আমার ছেলেবেলা ছিল উচ্ছ্বাস থেকে শিশুতোষ বেদনা অবধি। ছিল জোনাকি‚ ছিল জোৎস্না‚ ছিল কান্না‚ টুকটাক হাসি আর অবিরাম দুরন্তপনা। দিন যত যাচ্ছে আমি হারাচ্ছি নিজেকে। শৈশবে আমার সবটুকুই আমার ছিলো। আর, এখন আমার বৃহদাংশই পৃথিবীর। নিজের বলতে শরীরটা আর যেমন-তেমন বেঁচে থাকা।
আরও পড়ুন
Severe Cyclone Remal hit Bangladesh in May 2024 as a tropical storm of moderate intensity.…
Bangladesh is experiencing a heatwave and extreme weather. Today's highest temperature reached 42.6°C in Jashore…
Workaholism হলো মানুষের এমন এক স্বভাব যার উপকারী এবং অপকারী উভয় দিকই বিদ্যমান। এর উপর…
ওস্তাদে WZAMAN প্রোমো কোড ব্যবহার করলেই পাবেন ২০% থেকে ৩০% পর্যন্ত ডিসকাউন্ট। ফলে আপনার শেখার…
গ্রিক মিথোলজি অনুসারে, মেডুসা একসময় একজন অত্যন্ত সুন্দর নারী ছিলেন যিনি এমন এক সর্পকেশী দানবীতে…
রূপম ইসলাম (Rupam Islam) নামটা শুনলেই রক্তের উথাল-পাথাল টের পাওয়া যায়। কথা‚ সুর আর গায়কীর…
This website uses cookies.